‘সোহানপুরের সিথান-পৈতান ঘিরে সেই এক গাঙ– নাম তার জলখেলি। ওই পানে রোখ করেই শিশির-ঝুপঝুপা-সর্ষেক্ষেত কিংবা বোরোধানের চারাতলার পাছা-কিনারা ধরে দৌড়ের ভঙিমায় হেঁটে যায়। তার চলার ধরনে জান-খুলে চষে বেড়ানোর ভঙ্গিমা আছে। তার চলাচলে এমন একটা ভাব আছে যেন সে একা একা জেগে থাকে। যেন পুরানা রক্তের দলা ঠেলে-ঠেলে কোথাও যাচ্ছে ও। তখনও তার পরনে ছিল ময়লা-ছন্নছাড়া শার্ট।….. ফারুক দেওয়ানের দলে যুদ্ধ করা নয়ন মেলেটারির যুদ্ধের টাইমে হঠাৎ নিখোঁজ হয়ে যাওয়ায় জহির শুধু নয়, গাঁয়ের অনেকের ভিতর নতুন এক বিভ্রান্তি পয়দা হয়। পুন্নিমার ভাঙাচুরা ওমের এক আন্ধাচক্করে কিম্বা শঙ্কায় পড়ে তাদের কেউ কেউ। জহীরের চুলের গোড়া, রক্তময় কপালের ভাঁজ, গাল, এমনকি জুলফির একাকীত্ব বেয়ে সমানে ঘাম ঝরে, যেন ঘামের রায়ট লেগেছে তাতে।’
গেন্দু মেম্বার, মওলানা তবারকুল্লাহ, বাহারুদ্দী, গেসুদ্দী, আজম মৃধা, ফারুক দেওয়ান, বাহারুদ্দী, গাতক আব্দুল হাকিম, পরিমল, ফুলির মা, স্বর্ণা আপা, ফতু’র মা জয়ন্তি আর রঞ্জু ভাই সহ ছোটবড় অনেক চরিত্র চলে আসতে থাকে উপন্যাসের ঘটনাপ্রবাহের বাঁকে বাঁকে। পটভূমি একাত্তর। মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়। কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর’র এই উপন্যাসে মুক্তিসংগ্রামের সেই সময়ে সোহানপুর গ্রামের মানুষের জীবন-যাপনের চিত্র যেন আর দশটা গ্রামের মতোই। ঔপন্যাসিক তাঁর নিজস্ব ভাষাশৈলীর ব্যবহারে সেই যাপনের চিত্রকে এঁকেছেন। কোনও আরোপন নেই। পড়তে পড়তে ওসব জীবনের যাপনকে ছুঁয়ে আসা যায়।
স্পষ্টতই বুঝতে পারি কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর সচেতনভাবেই প্রমিত বাংলাকে এড়িয়ে আঞ্চলিক শব্দের ব্যবহারকে আখ্যান বর্ণনার মাধ্যম হিসেবে বেছে নিয়েছেন। এটি একেবারেই তাঁর নিজস্ব স্টাইল। একাত্তরের সেই টালমাটাল সময়ে লেখকের বয়স ছিলো আট। নিশ্চয়ই সেসময়ের সব দেখাকে পরিণত বুদ্ধিবৃত্তি নিয়ে বিশ্লেষণ করার সামর্থ্য তাঁর তখন থাকবার কথা নয়। কিন্তু দৃশ্যপটগুলো নিশ্চয়ই জ্বলজ্বলে ছিলো ভেতরে, যা পরে তাঁর লেখায় জীবন্ত হয়ে ওঠেছে। কিশোরগঞ্জের বাজিতপুরে বেড়ে ওঠা একজন কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীরকে তার লেখার মাধ্যমে জেনে নেওয়া যায়। চিকিৎসা বিজ্ঞানে অধ্যয়ন শেষে নিমগ্ন ডাক্তার হয়েই থাকতে পারতেন। পারেননি। সাহিত্যের ঝোঁক তাকে তেমন থাকতে দেয়নি। সম্পাদনা করেছেন ছোটকাগজ। লিখেছেন উপন্যাস, প্রবন্ধ। আমি তাঁর আর কোনও বই পড়িনি। তবে ‘যখন তারা যুদ্ধে’র পাতা উল্টাতে উল্টাতে আমি এক নিবেদিতপ্রাণ সাহিত্যসেবক, একজন অসম্ভব ধৈর্যশীল এবং উদ্ভাবনীশক্তিসম্পন্ন মানুষের পরিচয় পাই, যার হয়ত এই বিশেষ আঞ্চলিক ভাষার ঔপন্যাসিক উপস্থাপনা নিয়ে একটা লম্বা পরিকল্পনা ছিলো। বেঁচে থাকলে নিশ্চয়ই তিনি সেটিকে আরও বিস্তৃত করে দিতে পারতেন। তবে যেটুকু করেছেন তাতেও যে তিনি যথেষ্ট সফল সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। তাঁর লেখায় আঞ্চলিক ভাষার প্রয়োগে কী এক সুন্দর এসে আরোপনকে প্রতিরোধ করে দিয়েছে। মনে হয়, এভাবেই বলবার কথা ছিলো। অন্য কোনওভাবে নয়।
‘আগুন কাঁপাইন্যে মাইয়া মানুষের চলাচলতি তাকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব একজনের হাতে সঁপে নেওন উচিত।…. যুবক-বয়েসি ছেলেপেলের দিগদারী যে কোন্দিকে মোড় নেয় কে জানে। এর চেয়ে পাগল হোক আর মাজারে মাজারে ঘুরে বেড়াইন্যে আর বাদাইম্যে হলেও এমন একটা উল্টাপথে চলা মানুষকে সিধা পথে আনার ক্যাপাসিটি সারবানুর আছেই।’
চরিত্রগুলোকে তিনি বেহিসেবির মতো এনেছেন। কোথাও কোথাও সামান্যই বলেছেন কোনও কোনওটা নিয়ে। তবে তাঁর গল্প বলার ঢংটাই এমন যে, অল্প কথাতেও একটি চরিত্র চোখের সামনে ভেসে ওঠে। মনে হয় এই মাওলানা, এই গাতক, এই গেসুদ্দী আমার খুব চেনা। আর প্রোটাগনিস্ট জহীরও যেনো আমার নিজের গ্রামের দুলালটাই। এমনি প্রতিটি চরিত্রকে পাঠক মিলিয়ে নিতে পারবেন ঠিক ওরকমই আরেকজনকে দিয়ে।
যেকথা বলছিলাম, আরোপনহীন। প্রায় একশো পৃষ্ঠার এই উপন্যাসে টুকরো টুকরো জীবনছবি মুক্তিযুদ্ধকালের এক অনন্য প্রামাণ্যচিত্র যা পাঠ শেষে কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীরকে জানবার আগ্রহটা আরও আরও বেড়ে গেলো বহুগুণ।